চলমান সংকটের দায় কীভাবে এড়াবে আমাদের গণমাধ্যম?


বাংলাদেশের কণ্ঠ ডেস্ক প্রকাশের সময় : মার্চ ২৫, ২০২৩, ৯:২১ অপরাহ্ন /
চলমান সংকটের দায় কীভাবে এড়াবে আমাদের গণমাধ্যম?

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের পর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারতেন না। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম থাকলে সেখানে পুতিনের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা হতো। দেশের জনগণ এ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিত। জনমত ও মিডিয়াকে উপেক্ষা করে পুতিনের পক্ষে যুদ্ধে নামা সম্ভব হতো না। করোনার ভয়াবহতা শেষ না হতেই আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসত না। গার্ডিয়ান বলেছিল, যেকোনো দেশে মুক্ত গণমাধ্যম থাকলে পত্রপত্রিকা সরকার ও সরকারপ্রধানের ভুলভ্রান্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কথা না শুনলে বাজেভাবে সমালোচনা করে সরকারপ্রধানের। তখন সরকার ও প্রজাতন্ত্রের শীর্ষব্যত্তিরা গণমাধ্যমকে সমঝে চলে। পাশাপাশি জনগণকে ভয় করে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জনমত ও মিডিয়াকে গুরুত্ব দেয় সরকারপ্রধানরা। যেমন নিকট অতীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বাজেভাবে সমালোচনা করত সেদেশের পত্রপত্রিকা। দ্য গার্ডিয়ানে তাকে সমালোচনা করে প্রতিনিয়ত মতামত ছাপানো হতো। অবশেষে বরিস জনসন পদত্যাগে বাধ্য হন। বরিস জনসনের পর খুব স্বল্পসময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন লিজ ট্রাস। তার ভ্রান্ত নীতির কারণে মিডিয়া শুরু থেকেই সমালোচনায় মুখর হয়। অবশেষে তিনিও পদত্যাগে বাধ্য হন। যুক্তরাজ্যে বর্তমান ক্ষমতাশীন টোরি পার্টি। আর প্রধান বিরোধীদল লেবার পার্টি। ক্ষমতাশীন দল কনজারভেটিভ পার্টি (টোরি) ও বিরোধীদল লেবার পার্টিতে রয়েছে নেতৃত্বের সংকট। কিন্তু মুক্ত মিডিয়া উভয় দলকেই রীতিমতো তুলোধুনা করে। এ কারণে নেতৃত্ব সংকট থাকলেও রাষ্ট্রীয় সংকট নেই সে দেশে।

মুক্ত গণমাধ্যম বলাটা যত সহজ, বাস্তবায়ন অতটা সহজ নয়। কেবল গণতান্ত্রিক দেশেই এটি সম্ভব। কারণ রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, পোশাকি গণতন্ত্র, দলতান্ত্রিক সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার বদলের পক্ষেও নন। তাদের কাছে রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়। আর সরকারপ্রধান তো সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাই মুক্ত গণমাধ্যমের চেয়ে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগান তারা। অগণতান্ত্রিক এবং নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশে সবক্ষেত্রে সরকারের কাছে বলয় তৈরি করে রাখে স্বার্থপর দালাল গোষ্ঠী। তাদের কারণেই সরকার, রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে না। আর এসব দেশের অতিউৎসাহী সাংবাদিকরাও এ দালালশ্রেণির কাছাকাছি থাকে। তাদের মদদেই সরকার গণমাধ্যমকে নানা রকম হয়রানি ও নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, জণগণের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশন করতে ব্যর্থ হন সাংবাদিকরা। আর এতে চরমভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র।

গত ১০ বছর ধরে ব্যাংক খাতে চলছে নৈরাজ্য। আর এ নৈরাজ্যকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে আমাদের আমলাতন্ত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকে গত ১০ বছরে দুজন গভর্নর ও হাফ ডজন ডেপুটি গভর্নর কেবল চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে অনেক অনিয়ম সহ্য করেছেন। অনিয়ম করতে সহায়তা করেছেন। দুর্নীতিপরায়ণ শিল্পগ্রুপের পক্ষে তারা কাজ করেছেন ব্যক্তি স্বার্থে। একজন দেশপ্রেমিক রেগুলেটর পাওয়া যায়নি যে নির্ভয়ে এসব নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। পদত্যাগ করেছেন দেশের স্বার্থে। এসব ইয়েসম্যানদের জন্যই দেশে একের পর এক মেগা ঋণ অনিয়ম হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও গভর্নর ড. আতিউর রহমান কঠোর হস্তে ঋণ অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের আমলেই ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল বেদখল হয়। মুহিত সাহেব নীরবে এসব সহ্য করেছেন। তখন মুহিত সাহেব একজন দায়িত্বশীল অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা নিলে এটি সম্ভব হতো না। এতে তার মন্ত্রিত্ব গেলেও আজ বেঁচে যেত দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত।

কেবল আমলা ও রাজনীতিবিদরাই দেশের বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী নন। আমাদের গণমাধ্যমও অনেক দায়ী। ব্যাংক খাতে সব শেষ হওয়ার পর আমরা এখন সরব হয়েছি অনিয়ম নিয়ে। এতদিন কোথায় ছিলেন? চুরি-ডাকাতি শেষ হওয়ার পর থানায় জিডি করার ভূমিকায় নেমেছেন আপনারা? গত এক দশক গণমাধ্যমে এস আলম গ্রুপের পরিচয় ছিল চট্টগ্রামের এক বৃহৎ শিল্পগ্রুপ। বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম নিয়ে প্রতিটা গণমাধ্যম সরব থাকলে বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জসহ অন্যান্য অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হতো না। বিজ্ঞাপনের লোভকে পায়ে ঠেলে শীর্ষ মিডিয়া এস আলমসহ অন্যান্য দেশবিরোধী গ্রুপদের বিরুদ্ধে ইনভেস্টিগিটিং প্রতিবেদন ছাপালে দেশকে আজ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হতো না।

দেশ এক কঠিন সময় পার করছে। ডলার নেই। এলসি খুলতে পারছে না হাজারো প্রতিষ্ঠান। এলসি না খুলতে পারলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। লাখো কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্তরা। গত ১০ বছর কেবল অর্থনৈতিকভাবেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত নই, আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংসের কাছাকাছি। লোভ, লালসা ও ভয়ের কাছে বেশিরভাগ লোক বিক্রি হয়ে গেছি। আর অনেকেই বোবা হয়ে বসে আছেন। এ ব্যর্থতার জন্য আমরা মিডিয়া অনেক বেশি দায়ী। আমরা দায়িত্বশীল হতে পারিনি। পেশাদারিত্ব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি আমরা। আরাম, আয়েশ, লোভ ও ভোগ আমাদের বিবেককে কিনে নিয়েছে। আর এর খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

গত আট মাসে ছাপার কাগজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছে পত্রিকার অন্যান্য খরচ। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল বকেয়া অনেক দিনের। ৯০ শতাংশ পত্রিকায় চরম আর্থিক দৈন্য চলছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে দিন পার করছি আমরা। শেয়ার বিজ পত্রিকার বড় সম্পদ আমাদের কর্মিবাহিনী। তাদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শেয়ার বিজ। নতুন রূপে আবির্ভুত হওয়ার পর ছয় বছর পার করে সাত বছরে পা রেখেছে আমাদের প্রিয় পত্রিকা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রথম সংখ্যায় তাদের জন্য রইল ভালোবাসা। পত্রিকার পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, কলাম লেখকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধুদের হƒদয় নিংড়ানো প্রীতি, শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।